এই পূর্ণিমা দিনটি বৌদ্ধদের জন্য ঐতিহাসিক অভিস্মরণীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের ৩ মাস পরে মগধরাজ অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় অরহত মহাকশ্যপ স্থবিরের সভাপতিত্বে রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপর্ণী গুহায় ৫০০ শত অরহত ভিক্ষুদের উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি বা ভিক্ষু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে।
তথাগতের পরিনির্বাণ সংবাদ শোনার পর যাঁরা অনেকেই বুদ্ধকে দেখেনি তাঁরা শোকাবেগ সংবরণ করতে না পেরে কেউ বুক চাপড়িয়ে, কেউ মাথায় হাত দিয়ে, কেউ কেউ ছিন্নবৎ ভূতলে পতিত হয়ে ইতস্ততঃ এই বলে ক্রন্দন করছিলেন যে, কেন অতিশীঘ্রই ভগবান নির্বাপিত হলেন; অতি শীঘ্রই চক্ষুষ্মান পৃথিবী হতে অর্ন্তহিত হলেন। বিশেষ করে যারা পৃথকজন ভিক্ষু ছিলেন অর্থাৎ মার্গফল প্রাপ্ত হননি তারা কান্না থামাতে পারছিলেন না। সেই ভিক্ষুদের মধ্যে বৃদ্ধকালে প্রব্রজিত সুভদ্র নামে এক ভিক্ষু ছিলেন। তিনি শোকাহত ভিক্ষুগণকে বললেন তোমরা শোক করিও না। বিলাপ করিও না। আমরা এখন সেই তথাগতের বিভিন্ন শাসন, আদেশ ও নির্দেশ হতে মুক্তি পেয়েছি। এখন আমরা যা ইচ্ছা তা করতে পারব। বৃদ্ধ ভিক্ষুর কথা শুনে মহাকশ্যপ স্থবির মহোদয় অত্যন্ত মানসিকভাবে ব্যথিত হলেন। তিনি চিন্তা করল ভগবান পরিনির্বাণ হয়েছেন মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে এখনও তাঁর সুবর্ণময় দেহ ধরণীপৃষ্ঠে বিদ্যমান। সেই মুহূর্ত এই বৃদ্ধ ভিক্ষুর উক্তি যা বুদ্ধের শাসনে অশনি সংকেত।
অতঃপর দাহক্রিয়া শেষ হলে অরহত মহাকশ্যপ সেখানে উপস্থিত ৭ লক্ষ ভিক্ষুর সামনে বৃদ্ধ ভিক্ষু সুভদ্রের অন্যায় উক্তির কথা প্রকাশ করলেন। উপস্থিত ভিক্ষুগণ সুভদ্র ভাষিত উক্তি শুনে ভীষণ মর্মাহত হলেন। অরহত মহাকশ্যপ ধর্ম বিনয় পরিশুদ্ধ করার প্রস্তাব করলে সকলে তা সমর্থন করলেন। উপস্থিত ভিক্ষুগণের অনুরোধে অরহত মহাকশ্যপ বুদ্ধ প্রশংসিত ত্রিপিটক বিশারদ ধর্ম বিনয়ে গভীর জ্ঞানী প্রতিসম্ভিদাপ্রাপ্ত এরূপ ৫০০ অরহত ভিক্ষু নির্বাচন করলেন। আনন্দ স্থবির তখনও অরহত হতে পারেননি বলে তাঁর নাম উল্লেখ করেননি। ভদন্ত আনন্দ স্থবিরের নাম তালিকাভূক্ত করার জন্য উপস্থিত ভিক্ষুসংঘ বিনীতভাবে অনুরোধ জানালে অরহত মহাকশ্যপ তাঁকেও তালিকাভূক্ত করলেন। কারণ তিনি ভগবানের প্রধান সেবক হিসাবে সবসময় কাছে কাছে থাকতেন বিধায় সম্মেলনে স্মৃতিমান আনন্দের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী। এই সম্মেলন কখন কোথায় অনুষ্ঠিত হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য তালিকাভূক্ত ভিক্ষুদের নিয়ে অরহত মহাকশ্যপ রাজগৃহ অভিমুখে যাত্রা করলেন। অন্যান্য ভিক্ষুসংঘকে তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে বা আরামে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন।
তখন মগধের রাজা ধর্মপ্রাণ অজাতশত্র“ ভিক্ষুসংঘের আগমন সংবাদ পেয়ে খুবই খুশী হলেন এবং অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাজগৃহে উপস্থিত হয়ে রাজার নিকট ধর্ম বিনয় সঙ্গায়ণ করার প্রস্তাব করলে রাজা তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হয়ে অরহত মহাকশ্যপকে বললেন, আপনারা বিশ্বস্থভাবে ধর্ম সঙ্গায়ণ করুন আমার রাজাজ্ঞা আপনাদের ধর্মাজ্ঞা সু-প্রতিষ্ঠায় প্রবর্তিত হউক। অতঃপর রাজা ভিক্ষুদের অনুমতিক্রমে সপ্তপর্ণী গুহাদ্বারে পঞ্চশত ধর্মমন্ডপ প্রস্তুত করলেন। দক্ষিণ দিকে উত্তরমুখী করে স্থবিরগণের আসন সু-সজ্জিত করলেন। মন্ডপের মধ্যভাগে পূর্বমুখী করে ভগবানের আসন তুল্য ধর্মাসন নির্মাণ করে দন্ডখচিত ব্যজনী স্থাপন পূর্বক দেবতুল্য চমৎকার এক মন্ডপ তৈরী করালেন।
শ্রাবণী পূর্ণিমার পূর্বদিন ভিক্ষুসংঘ ভদন্ত আনন্দ স্থবিরকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। অরহত না হয়ে সম্মেলনে যোগদান করা আপনার উচিত হবে কি? আমাদের অনুরোধে হয়ত আপনাকে তালিকাভূক্ত করেছেন কিন্তু বীর্যবানের পক্ষে ইহা শোভনীয় নয়। ধর্ম ভান্ডারাধ্যক্ষ হিসাবে খ্যাত, তথাগতের সঙ্গে ছায়ার মত বিচরণকারী ধর্ম বিনয়ে পন্ডিত আনন্দ স্থবির লজ্জায় এক রাত্রির মধ্যেই অরহত্ত্ব ফল প্রাপ্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। আনন্দ ভাবলেন আমাকে অরহত হতে হবে এবং অরহত হয়েই সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। সমস্ত রাত্রি তিনি তার মনের শক্তি দিয়ে কায়গত স্মৃতি ভাবনায় রত হলেন। সারারাত্রি অবিশ্রান্ত কঠোর সাধনা করে বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন তথাপি তৃষ্ণামুক্ত হতে পারেননি। বার বার বুদ্ধের কথা স্মরণ করছেন, বুদ্ধ বলেছিলেন -অচিরেই তুমি তৃষ্ণামুক্ত হবে। বুদ্ধবাণী তো মিথ্যা হতে পারে না। হতাশায় ও বেদনায় ক্লান্ত হয়ে শয়ন উদ্দেশ্যে ভূমিতল হতে পদতল উঠাচ্ছেন। হেলে পড়ছেন বালিশে মাথা রাখার ইচ্ছায়। ঠিক সেই সময়েই তিনি অরহত্ত্ব মার্গফল লাভ করলেন। সম্মেলন আরম্ভের কিছুক্ষণ পূর্বেই তিনি তাঁর জন্য রক্ষিত আসনে মাটি ভেদ করে উপবিষ্ট হলেন। উপস্থিত সকলেই বুঝলেন যে আনন্দ বীর্যবানের পরিচয় দিয়েছেন এবং ভিক্ষু করণীয় কাজ সম্পাদন করেছেন। যথাসময়ে অরহত মহাকশ্যপের সভাপতিত্বে বক্তব্য প্রদানের জন্য বিনয়ধর উপালী স্থবিরকে আহবান জানালেন। উপালী স্থবির ধর্মাসনে বসে বিনয় আবৃত্তি করলেন। পূর্বোক্ত নিয়মে আনন্দ স্থবির ধর্মাসনে বসলেন। অরহত মহাকশ্যপ তাঁকে সূত্র ও অভিধর্ম বিষয়ে প্রশ্ন করলেন অরহত আনন্দ স্থবির উত্তর প্রদান করেন। সেই উত্তর যথাযথ হচ্ছে কিনা উপস্থিত ভিক্ষুরা তা পর্যালোচনা করেন। এইভাবে পঞ্চশত অরহত দ্বারা প্রথম সঙ্গীতির কার্য্য সু-সম্পাদিত হয়েছিল বলে ইহা পঞ্চশতিকা সঙ্গীতি নামে অভিহিত।
অতএব, এই শ্রাবণী পূর্ণিমা দিনটি উল্লেখ যোগ্য দুটি বিষয়ই বৌদ্ধদের ঐতিহাসিক অভিস্মরণীয় দিন। বিশেষত বুদ্ধের জীবদ্দশায় ৪৫ বৎসর ব্যাপী ধর্ম প্রচার করে যা যা তিনি ভাষণ করেছিলেন, সেই ভাষিত উপদেশ নিয়েই ত্রিপিটক শাস্ত্র। সেই ত্রিপিট শাস্ত্রই প্রথম সঙ্গায়ণে থেকে চয়ণ করা হয়েছিল।